uttaraganabhaban

রাজবংশের ইতিহাস

জগন্নাথ রায় (১৭৪৫-১৭৯০)
দয়ারাম রায় এর একমাত্র পুত্র জগন্নাথ রায় জন্মগ্রহণ করে ১৭৪৫ সালে। সেই সময় নাটোরের রাজা ছিলেন রামকান্ত রায়। আলীবর্দী খাঁ তখন বাংলা- বিহার- উড়িষ্যার নবাব।দয়ারাম রায়ের মৃত্যুর সময় জগন্নাথ রায় ১৫ বছরের বালক। দিঘাপতিয়া রাজ বংশের জন্য জগন্নাথ রায়ের বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোন কীর্তি নেই।১৭৭০ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় দিঘাপতিয়া রাজা জগন্নাথ রায় ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে। রাজা দয়ারাম রায় যে ধন-দৌলত রেখে গিয়েছিলেন তার নিঃশেষ হয়ে যায় অচিরেই। সরকারের খাজনা বাকি পড়ায় জগন্নাথ রায় জমিদারি বিক্রি করতে মনস্থ করেন। এই সংকটকালে জগন্নাথ রায়ের স্ত্রীর নন্দরানী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।তার পরামর্শে অতিকষ্টে খামারের আয় থেকে সংসার প্রতিপালন করে জমিদারি আয় থেকে সরকারের খাজনা পরিশোধ করা হয়। সারাবাংলায় তখন এক চরম সংকটকাল। খরা প্রবণ হওয়ায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় রাজশাহী জেলা ক্ষতির পরিমাণ ছিল সাংঘাতিকভাবে বেশি। জগন্নাথ রায় তার জীবনে সাংসারিক ও মানসিক অশান্তির মধ্যে কাটিয়েছেন। তার ষোলটি সন্তানের মধ্যে একমাত্র প্রাণনাথ ছাড়া সবাই অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ১৭৯০ সালে জগন্নাথ রায় মাত্র ৪৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন । দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বা জনগণের কল্যাণ প্রশ্নে তার তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অবদান নেই।

প্রাণনাথ রায়(১৭৮৬-১৮২৭)
১৭৮৬ সালে প্রাণনাথ এর জন্ম হয়। পিতার মৃত্যুর সময় তিনি মাত্র ৪ বছরের বালক।সুতরাং জগন্নাথের মৃত্যুর পর দিঘাপতিয়ার জমিদারি কোড অফ ওয়ার্ডেরসের এর অধীনে ন্যস্ত হয়।প্রাপ্ত বয়সে প্রাণনাথ জমিদারির ভাগ পানি। কাশিমবাজারের মহারাজ কৃষ্ণনাথ ছিলেন প্রাণনাথের অন্তরঙ্গ বন্ধু। প্রাননাথ ছিলেন এক বিলাসী চরিত্রের মানুষ। দান করতেন প্রচুর। তাছাড়া তিনি ক্রীড়া রসিকও ছিলেন । বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি পোষার শখ ছিল তার।চরম বিলাসী চরিত্রের অধিকারী হওয়ায় প্রাণনাথের সময় দিঘাপতিয়া জমিদারির বেশ ক্ষতি হয়।তার আমলেই তার কর্মচারী রঘুনাথ গিরি গোসাই নওখিলা পরগনা লিজ নেন।হাজার ১৮২৭ সালে ৪১বছর বয়সে প্রাণনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মৃত্যুকালে তিনি কোন পুত্র সন্তান রেখে যেতে পারেননি।

রাজা প্রসন্ননাথরায় (১৮২৬-১৮৬১)

রাজা প্রসন্ন রায় ছিলেন অপুত্রক জমিদার প্রাণনাথের দত্তকপুত্র। রাজা প্রাণনাথের মৃত্যুর পর উপযুক্ত উত্তরাধিকার না থাকায় তার সম্পত্তি কোড অব ওয়ার্ডসের এর অধীনে চলে যায়। প্রসন্ন নাথ খুব বেশি মেধাবী ছিলেন না। রাজশাহী জিলা স্কুলে তিনি পড়ালেখা করেন। লেখাপড়া ছাড়ার পর তিনি কতিপয় ইউরোপীয়নদের কুস্বর্গে পড়েন ও বিলাসী স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই দূষিত চরিত্রের প্রসন্ননাথ নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং কুপথ ত্যাগ করেন( কলকাতা রিভিউ) রাজশাহী -নাটোর রাজপথকে প্রসন্ননাথ দিঘাপতিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারন এবং বগুড়াগামী রাস্তর সাথে সংযুক্ত করেন।১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এ রাজপথ সংস্কারের জন্য তিনি সরকার কে এককালীন ৩৫,০০০,০০ টাকা দান করেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, অন্যান্য জমিদার ও কুঠিয়ালদের সহায়তায় তিনি রাজশাহী জেলার প্রথম দাতব্য চিকিৎসালয় হিসেবে নাটোর দাতব্য চিকিৎসালয় ( বর্তমানে নাটোর সদর হাসপাতাল) স্থাপন করেন। তৎকালের অন্যতম মহামারী রোগ কলেরা রোগীদের চিকিৎসা ও ঔষধ সরবরাহ করত এ প্রতিষ্ঠান। তার মৃত্যুর পর তার দানের অর্থে গড়ে ওঠে রাজশাহী দাতব্য চিকিৎসালয়( আজকের রাজশাহী সদর হাসপাতাল)। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে নাটোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্ননাথ প্রতিষ্ঠিত প্রসন্ননাথ একাডেমির সাথে একীভূত হয়।যা পরে প্রসন্ননাথ উচ্চ বিদ্যালয় তথা আজকের দিঘাপতিয়া পিএন হাই স্কুলের রূপান্তরিত হয়। এটিই নাটোরের সর্বপ্রথম উচ্চ বিদ্যালয়।১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুলাই প্রসন্ননাথ রায় তদানিন্তন সরকারকে১,০৪,৫৬৭ টাকা দান করে লিখেছিলেন, রাজশাহী জেলা বাসীর মঙ্গলার্থে আমি সরকারকে এই অর্থ দান করতে ইচ্ছুক এই অর্থ নাটোরের দাতব্য চিকিৎসালয় আমার নবপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় এবং বোয়ালিয়ার চিকিৎসা কেন্দ্রের উন্নতির জন্য ব্যয় করা হোক তা আমি আশা করি সরকার যদি আমার ইচ্ছা অনুযায়ী এই অর্থ সদ্ব্যবহার করে তাহলে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতায় পাশে আবদ্ধ থাকবো।এ দানের জন্য সরকার ভূয়সী প্রশংসা করে বিভাগীয় কমিশনারকে পত্র দেয়। তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ও চিকিৎসালয় সমূহ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকার কমিটি গঠন করে দেয়। বিভাগীয় কমিশনার,জেলা জজ, কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট এবং সিভিল সার্জন পদাধিকারবলে উক্ত কমিটিতে সদস্য ছিলেন।নাটোর মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি কে নিয়ে আরেক আর একটি উপকমিটি হয়।তার দান ও সৎকাজের জন্য ১৮৫৪ সালের ২০ এপ্রিল বড়লাট ডালহৌসী বেলডেভিয়ার সরকারি প্রসাদের এক বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রসন্ননাথ কে "রাজা বাহাদুর" সনদ প্রদান করেন।১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১০সেপ্টেম্বর প্রসন্ননাথ "রাজাবাহাদুর" আনারারি সহকারি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন এবং তার অধীনে পুলিশের একজন জমাদার ও ২০ বরকন্দাজ নিযুক্ত ছিল। দয়ারাম রায় প্রতিষ্ঠিত দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ কে তিনি আরও সুন্দর করে গড়ে তোলেন। কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে প্রতিদিন সেখানে এক মণ চালের ভোগ ও রাতে লুচির ব্যবস্থা করতেন। কালীমন্দির ও সংরক্ষিত আছে (দিঘাপতিয়া এতিমখানা সংলগ্ন) দয়ারাম রায়ের মত প্রসন্ননাথও প্রজা কল্যাণের অনেক পুকুর ও দীঘি খনন করেন দিঘাপতিয়া সিংহ দালান, দোল মঞ্চ ইত্যাদি তাঁর কীর্তি। যদিও বেশির ভাগই স্থাপনা ১৮৯৭খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিদ্যোৎসাহী ও সমাজ হিতৈষী হলেও রাজা প্রসন্ননাথ নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন না। জমিদারি নীল রক্তের বিলাসী চমক থেকে তিনি অব্যাহতি পাননি। দেশি-বিদেশি বহু অতিথি তার রাজপ্রাসাদে এসে আমোদ ফুর্তি করেছেন। বন্ধু বান্ধব নিয়ে শিকার সিংহদালানে যৌবন-রসসিক্ত প্রমোদ প্রমোদ ছিল তার অন্যতম আকর্ষণ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে উচ্ছল প্রসন্ননাথ রায় দত্তকপুত্র প্রমথনাথ রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন।

রাজা প্রমথনাথ রায় (১৮৪৭-১৮৮৩)

রাজা প্রসন্ননাথের দত্তক পুত্র ছিলেন প্রমথনাথ রায়।১৮৪৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। রাজা দয়ারামের কন্যার দিক থেকে তিনি প্রত্যক্ষ বংশধর ছিলেন। ১৮৫৪ সালে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় পাস হয় এক্ট ২৬। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল কোর্ট অব ওয়ার্ডেসের তত্ত্বাবধানে নাবালক জমিদারগণ এর শিক্ষার উন্নত ব্যবস্থা করা। এর ফলে ৮থেকে ১৪ বছর বয়সী নাবালকদের একটি আলাদা বাড়িতে একত্রে রেখে উপযুক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়। কলকাতার মানিকতলা আপার সার্কুলার রোডে শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউশনে ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে পরিচালক নিযুক্ত হয়। এখান থেকে প্রমথনাথ প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। প্রবেশিকা পাশ করার পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বেশিদিন লেখাপড়া করতে পারলেন না। রাজা প্রসন্ননাথের ইস্ত্রি দানশীল ভবো সুন্দরী (১৮৩২-১৯০৩) সেসময় কলকাতা বাস করতেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পর তিনি ধর্ম কর্ম এবং দাম কাজে সময় ব্যয় করতেন। দিঘাপতিয়া থাকাকালে তিনি দৈনিক ১০০ জন অতিথি কে দেব মন্দিরের ভোজন করাতেন। প্রমথনাথ ভবসুন্দরী অনেক গুণ পেয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তিনি ছিলেন মাতৃভক্ত। ১৮৬৭সালের নভেম্বর মাসে সাবালক হওয়ার পর তিনি দিঘাপতিয়া জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই জমিদারি কাজে দক্ষ হয়ে যথেষ্ট সম্মান এবং প্রতিপত্তির অধিকারী হন। ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনে তিনি ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের তত্ত্বাবধায়নে লেখাপড়া করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় ও সৌজন্যে রাজশাহীবাসীর শিক্ষা ও ললিতকলার পথে অগ্রসর হওয়ার সহজ হয়েছিল। তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর কিছুদিন অনভিজ্ঞ ছিলেন। অন্যান্য জমিদারদের মতো তিনি সুখ বিলাসী ছিলেন না। লেখাপড়ার প্রতি তার আগ্রহ ছিল সীমাহীন। ইংরেজি সাহিত্য, বিজ্ঞান ,ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। দুপুরে তিনি এসব নিয়ে সময় কাটাতেন। জ্ঞানী ব্যক্তিদের সান্নিধ্য তিনি পছন্দ করতেন।